প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ব্যাপারে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন এবং শব্দ ব্যবহার করছেন, সমালোচকরা বলছেন তিনি আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করছেন। কিন্তু তিনিই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নন, যার বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধকালীন সময়ে এরকম অভিযোগ উঠলো।
ইরানের সাংস্কৃতিক স্থাপনায় হামলা করার যে হুমকি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, তা ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে এবং তার কর্মকর্তারা দ্রুত জানিয়ে দিয়েছেন যে, সেরকম কোন কিছু আলোচনা হচ্ছে না।
এর আগে তিনি ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন জেনারেলকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সরকার তখনই এ ধরণের পদক্ষেপ নিতে পারে, সেটা যদি আত্মরক্ষার জন্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, তারা ভবিষ্যৎ হামলা ঠেকানোর জন্য এটি করেছেন।
তবে জাতিসংঘের বিচার বহির্ভূত হত্যা বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোটিয়ের অ্যাগনেস কালামার্ড তাদের ওই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তিনি একটি টুইট বার্তায় বলেছেন, জাতিসংঘ চার্টারে যা রয়েছে, ওই হামলা তার মধ্যে পড়ে না।
৩৩ আর্চিস ব্রিজ, ইরানের একটি সাংস্কৃতিক স্থাপনা
যুক্তরাষ্ট্রের যে সামরিক কর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মতো অভিযোগ উঠেছে, তাদের একজন স্পেশাল অপারেশন্স চিফ এডওয়ার্ড গ্যারাগারের বিষয়ে তিনি প্রশংসা করে বলেছেন, ‘কঠিন ব্যক্তি’।
যেখানে সামরিক ব্যক্তি এবং অভিযানের ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্প কথা বলেন, তা সেসবের আইনের চোখে বৈধতার ব্যাপারটিকে অস্পষ্ট করে তোলে।
যেমন কোন সাংস্কৃতিক স্থাপনার ওপর হামলা ১৯৫৪ সালের হেগ কনভেনশন ফর দি প্রোটেকশন অফ কালচারাল প্রোপার্টির মতো আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করে। কিন্তু তিনি তার বক্তব্যের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছেন, বিপক্ষ কমান্ডাররা বেআইনি পন্থায় কাজ করছে, সুতরাং আমেরিকাকেও সেটাই করা উচিত।
তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ”আমাদের লোকজনের ওপর তাদেরকে নির্যাতন করতে দেয়া হচ্ছে আর আমরা তাদের সাংস্কৃতিক স্থাপনা স্পর্শ করতে পারবো না? এভাবে হয় না।”
আন্তর্জাতিক আইন নাকচ করে দেয়ার মাধ্যমে তিনি এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদেরও বিস্মিত করে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার বলেছেন, ”আমি পুরোপুরি নিশ্চিত যে আমাদের প্রেসিডেন্ট, কমান্ডার ইন চিফ এ ধরণের কোন বেআইনি আদেশ দেবেন না।”
দায়িত্ব পালনকালে গোপন ড্রোন অভিযানের পক্ষে ২০১৯ সালে ব্যাখ্যা তুলে ধরেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা
এটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য আরেকটা অসামান্য বছর যেখানে তার এবং মন্ত্রিসভার মধ্যে মতবিরোধ প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসেছে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নন যিনি এ ধরণের জ্বলন্ত বানী অথবা আগ্রাসী সামরিক নীতি দিয়ে জনগণকে হতভম্ব করে দিয়েছেন। শত বছর ধরে এসব নীতির ক্ষেত্রে বিতর্ক হয়েছে এবং প্রেসিডেন্টে সঙ্গে জনগণের ক্ষোভের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসেরই একটি অংশ।
৪৫তম প্রেসিডেন্ট দপ্তরের দায়িত্ব নেয়ার অনেক আগে, রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট নেতাদের সেসব সামরিক এবং গোয়েন্দা অভিযানগুলোর ব্যাপারে গোপনে তদারকি করতে দেয়া হয়েছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে আইন আর বেআইনের সীমার অস্পষ্টতা রয়েছে।
প্রেসিডেন্টদের অনেকে তাদের নীতিগুলো ন্যায়সঙ্গত করার চেষ্টায় মিলিটারি ফোর্সের ব্যবহারের অনুমোদন (এইউএমএফ) নামের একটি আইনের অনুমোদন নিয়ে লড়াই করেছেন।
এই আইনে যারা ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামলায় সহায়তা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্টরা ওই আইনকে বিস্তৃত করে ব্যাখ্যা করেছেন এবং বিশ্ব জুড়ে সামরিক অভিযানের বৈধতা দিতে সেটির ব্যবহার করেছেন।
বারাক ওবামা তার দায়িত্ব পালনকালে গোপন ড্রোন হামলার অন্তত ৫৪০টি আদেশ দিয়েছেন।
তথাকথিত ‘উন্নত জিজ্ঞাসাবাদ পদ্ধতির’ অনুমোদন দিয়েছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ, যেখানে নির্যাতনের পদ্ধতি হিসাবে মুখে কাপড় দিয়ে পানি ঢালাসহ অন্যান্য কৌশল খাটানো হতো।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন যে, এভাবে বিমান হামলা আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনের লঙ্ঘন, তবে মি. ওবামা বিমান হামলার আইনি ভিত্তি রক্ষা করে চলেছেন। তার উপদেষ্টারা যুক্তি দেন যে, যাদের বিরুদ্ধে হামলা করা হয়েছে, তারা আমেরিকানদের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা করছিলেন, ফলে তাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যেই পড়ে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওবামার বিরুদ্ধে সমালোচনা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্সিয়াল ইতিহাসবিদ রুৎজারর্স ডেভিড গ্রিনবার্গ বলছেন, প্রেসিডেন্টের বিমান হামলাকে দেয়া হয়েছে যুদ্ধের সবচেয়ে খারাপ বর্বরতাকে সীমাবদ্ধ করা হিসাবে।
তার পূর্বসূরি জর্জ ডব্লিউ বুশ অবশ্য হাতে গোনা কিছু বিমান হামলার অনুমোদন দিয়েছিলেন। তবে তিনি যুদ্ধবিগ্রহকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
তথাকথিত ‘উন্নত জিজ্ঞাসাবাদ পদ্ধতির’ অনুমোদন দিয়েছিলেন তিনি, যেখানে নির্যাতনের পদ্ধতি হিসাবে মুখে কাপড় দিয়ে পানি ঢালাসহ অন্যান্য কৌশল খাটানো হতো।
ইতিহাসবিদ ডেভিড গ্রিনবার্গ বলছেন, ”ইরাক যুদ্ধ এবং নির্যাতন কৌশলের কারণে বুশকে স্মরণে রাখতে হবে।”
তারও আগে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বিচার বহির্ভূত পথ বেছে নিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসবাদীদের অন্য একটি দেশে নিয়ে যাওয়া হতো, যেখানে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো।
ক্লিনটন ও অন্য প্রেসিডেন্টরা তাদের নীতির আইনগত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
ইন্ডিয়ান রিম্যুভাল অ্যাক্টে’ স্বাক্ষর করেছিলেন অ্যান্ড্রু জ্যাকসন, যে আইনের বলে আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
শত বছর আগে আগে অ্যান্ড্রু জ্যাকসন, যিনি ১৮০০ সালের শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, ঠিক একই কাজ করেছিলেন।
তিনি ‘ইন্ডিয়ান রিম্যুভাল অ্যাক্টে’ স্বাক্ষর করেছিলেন, যে আইনের বলে আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
অনেকে বলেন, তাদের জোর করে উচ্ছেদ করার ঘটনা ছিল ‘বর্বরতা,” বলছেন গ্রিনবার্গ। কিন্তু সেখানে অন্তত নিয়ম মেনে চলার একটা অজুহাত ছিল।
কিন্তু সেরকমভাবে নিজের নীতিকে আবদ্ধ করার কোন দরকার বোধ করেন না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, বলছেন ইতিহাসবিদ গ্রিনবার্গ।
”আপনি চাইলেই কোন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বোমা ফেলতে পারেন না। কিন্তু তিনি যেন উল্লাসের সঙ্গে সেটা করতে চলেছেন।”
ট্রাম্পের সমর্থকরা বলছেন, তাঁর আড়ম্বরপূর্ণ ভাষা সত্ত্বেও আগের প্রেসিডেন্টদের তুলনায় তিনি সামরিক নীতির ক্ষেত্রে অনেক বেশি নিয়মনিষ্ঠ।
হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের একজন বিশ্লেষক জেমস কারাফানো বলছেন, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আসলে কী করছেন, তা নিয়ে সতর্ক ছিলেন ট্রাম্প- যারা হচ্ছে সবচেয়ে রক্ষণশীল এবং সবচেয়ে সংযত।
অন্য অনেক বিশ্লেষক বলেন, আসল সমস্যা হলো প্রেসিডেন্টদের অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং তারা কোন বিষয়কে অনেক দূর টেনে নিয়ে যেতে পারেন।
”তারা তাদের ক্ষমতাকে এমন কার্যক্রমে ব্যবহার করেছিল, যা আমরা অবৈধ, অনৈতিক বলে মনে করি- আপনি যেভাবেই বলেন না কেন,” বলছেন অ্যান্ড্রু বাসিভিচ, পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান কুইনসি ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট।
তিনি বলছেন, যুগে যুগে প্রেসিডেন্টরা আইনের সীমা নিয়ে ঠেলাঠেলি করেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতে তাহলে কি ঘটতে চলেছে? সূত্র: বিবিসি বাংলা।