নানকার বিদ্রোহ বা আন্দোলন সিলেট অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য একটি অধ্যায়। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিচারে নিম্নতম শ্রেণীর লোকের এ বিদ্রোহ এবং সংগ্রাম একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। ভাষা আন্দোলনের আওতা ছিল ব্যাপক। জাতীয় পর্যায়ভুক্ত। নানকার আন্দোলন ছিল সিলেটের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার একান্ত ফসল। জমিদার মিরাশদার তালুকদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে সাধারণ প্রজার চেয়েও নিম্ন শ্রেণীভুক্ত নানকার প্রজাদের বিদ্রোহ সিলেট অঞ্চলের সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিতান্ত অবহেলিত, শোষিত মানুষের উত্থানরূপে গণ্য হতে পারে। সিলেটের স্থানে স্থানে এ বিদ্রোহ দেখা দেয়। জমিদার মিরাশদার শ্রেণীর লোকজন এতে রীতিমত বিস্মিত হন। তারা ভাবতেও পারেননি যে তাদের পুতায় বা ভিটায় বাস করে তাদের হুকুমের চাকর হয়ে তাদের খেয়ে প্রজারা এমন দুঃসাহস প্রদর্শন করতে পারে। নানকার বিদ্রোহ এদিক থেকে সমাজের উপর তলাতেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
‘নান’ ফারসি শব্দ; অর্থ-রুটি। ‘কার’ শব্দের অর্থ কাজ। নানকার বলতে সেই জমি বুঝায় যা কেবলমাত্র ভোগের জন্য অন্যকে দেয়া হয়েছে। মালিকানা দেয়া হয়নি। কেউ কেউ তাই ‘নাই কর যার’, অর্থে নানকার শব্দের ব্যাখ্যা দেন। মালিক যে কোনো সময় ঐ জমি বা বাড়ি থেকে ভোগকারীকে উচ্ছেদ করতে পারে। নানকার প্রজা বলতে বোঝায় ঐ প্রজা যে খাদ্য অর্থাৎ সামান্য জমি বাড়ি ভোগের বিনিময়ে জমিদার বা মিরাশদারের সার্বক্ষণিক চাকর হয়ে থাকবে। সিলেট অঞ্চলে জমিদার মিরাশদার তালুকদার শ্রেণীর ভূস্বামীরা নানকার প্রজা রাখতেন। এই রেওয়াজকে বেগার প্রথা বা চাকরান প্রথাও বলা হতো।
নানকার প্রজাদের নিজস্ব বলতে কিছুই ছিলনা। মালিকের ফাইফরমাশ খাটা, যে কোনো হুকুম তামিল করাই ছিল তাদের কর্তব্য। ছেলেমেয়ে, বৌ-ঝিদেরও পুরুষানুক্রমে এই শৃঙ্খলে বাঁধা থাকতে হতো। কিরান, ভা-ারী, নমশূদ্র পাটনী, মালী, ঢুলী, ক্ষৌরকার প্রভৃতি পেশাভিত্তিক শ্রেণীর লোকজন ছিলেন নানকার প্রজাভুক্ত।
সামন্তবাদী এ প্রথার বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯২২-২৩ খ্রীষ্টাব্দে। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থানার সুখাইড় গ্রামে জমিদারের বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে প্রজারা রুখে দাঁড়িয়েছিল। জনৈকা রমণীকে প্রজারা জমিদারের খপ্পর থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। এই অভিযানের নেতৃত্বদানকারী ব্রজবাসীর সন্ধান পরে পাওয়া যায়নি। ব্রজবাসী নিজেই নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন নাকি জমিদাররা তাকে গুম করে হত্যা করেছিলেন তা জানা যায়নি।
এরপর ১৯৩১-৩২ খ্রীষ্টাব্দে কুলাউড়া, ১৯৩৮-৩৯ খ্রীষ্টাব্দে সুনামগঞ্জের দিরাই থানার রফিনগর, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, সিলেটের রনকেলী, ভাদেশ্বর, বাহাদুরপুরসহ অন্যান্য স্থানে সংগঠিত অসংগঠিত বিদ্রোহের ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৯৪৫ খ্রী. বিয়ানীবাজারের লাউতা এলাকায় সংগঠিত বিদ্রোহের সূচনা হয়। জোয়াদ আলী, আব্দুস সোবহান, হামিদ আলী প্রমুখ এতে নেতৃত্ব দেন। ঐ সময় বসত ভিটার উপর স্বত্ব লাভের দাবি ছিল প্রধান।
নানকার প্রজাদের এই বিদ্রোহ দানা বাঁধার পর্যায়ে প্রথমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরে দেশভাগ ও গণভোটের জন্য সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়ে আসে। ১৯৪৭ এর পর তা আবার নতুন করে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আন্দোলন ক্রমাগত প্রসার লাভ করতে থাকে। বিয়ানীবাজার আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এর প্রধান এলাকা ছিল লাউতা, বাহাদুরপুর, সানেশ্বর, নন্দিরপুল, গোলাপগঞ্জ, রনিকাইল, ফুলবাড়ী, ভাদেশ্বর, দক্ষিণভাগ, বালাগঞ্জের বোয়ালজুর, ফেঞ্চুগঞ্জের মৌরাপুর ইত্যাদি। লাউতা নিবাসী অজয় ভট্টাচার্য ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তিনি ‘নানকার বিদ্রোহ’ নামে তিন খ-ে সমাপ্ত গ্রন্থে এ ইতিহাস ধরে রেখেছেন।
১৯২২ থেকে বিরাজমান অসন্তোষের সুসংগঠিত প্রকাশ ঘটে ১৯৪৯ এর ১৮ আগস্ট। বিয়ানীবাজারের উলুউরি ও সানেশ্বর গ্রামের মাঝখানে সুনাই নদীর তীরে নানকার প্রজাদের সমাবেশে পুলিশ ও ইপিআর গুলি চালায়। প্রজারা বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। ছয় জন প্রজা নিহত হন।
সমগ্র আন্দোলনকে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনরূপে প্রচারের ফলে তখন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। তাই ঘটনার আগে এলাকায় পুলিশ ও ইপিআর-এর ঘাটি স্থাপন করা হয়েছিল। ঘটনার পর গ্রামবাসী নারী-পুরুষের উপর জমিদার শ্রেণীর লাঠিয়াল এবং পুলিশ-ইপিআর অকথ্য নির্যাতন চালায়। গণসঙ্গীত শিল্পি ও কবি হেমাঙ্গ বিশ্বাস করুণ এ ঘটনা নিয়ে গান রচনা করেছিলেন :
সুনাই গাঙ তোমার কেনে উতলা পানি/ সানেশ্বরের কারবালায় কারা জান দিল-কুরবানী/ কও বন্ধু কও একবার শুনি…।
নানকার প্রথা সিলেটেই কেন প্রতিষ্ঠিত ছিল- এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি লিখেছেন ঃ ইতিহাসবিদরা এই পদ্ধতির উদ্ভবের জটিল দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় একটি নির্দিষ্টরূপে এই পদ্ধতি কেন কার্যকর ছিল, সে ব্যাপারে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা বৈশিষ্ট্য ও চর্চা এবং একই সাথে এর জনমিতিক বৈচিত্র্যগুলি সমন্বয়ে একটি বিশেষ পদ্ধতির উদ্ভব হয়, যা অন্যত্র হয়তো হয় না।
এ আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে নজিব আলী, আকবর আলী, নঈম উল্লা, শিশির চক্রবর্ত্তী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ১৯৫০ এর পর নানকার প্রথা আইনের মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়।
তথ্য সূত্র :
১, আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন; সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য; পৃঃ ২২৯-৩০, প্রকাশঃ ১৯৯৫। ২. উদ্ধৃতি ঃ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম; ইতিহাসের পুননির্মাণ এবং সিলেটের নানকার বিদ্রোহ, প্রবন্ধ ; সিলেটঃ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, পৃঃ-১৮১, সম্পাদক-শরীফ উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, ১৯৯৯।
৩. এ ছাড়া তথ্য নেয়া হয়েছে-অজয় ভট্টাচার্যের নানকার বিদ্রোহ, বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস, সিলেট গাইড গ্রন্থ এবং দেওয়ান আজরফ, মোঃ আব্দুল আজিজ প্রমুখের লেখা থেকে।