কমল সরকার’ গৌরীপুর: ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামীন অঞ্চলের কৃষকগন চৈত্র-বৈশাখে আউশ ধান, আষাঢ়-শ্রাবনে আমন ধান, পৌষ-মাঘে বোরো- আউশ ধান বপনের সময় এলেই প্রতিদিন শুকনো মাছের ভর্তা, শুকনো মড়িচ, কাচা মড়িচ বা পেয়াঁজ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে প্রতিদিন ভোর বেলায় বেরিয়ে পড়তেন মাঠে লাঙ্গল জোয়াল, গরু নিয়ে জমি চাষের জন্য। এক সময়ে গ্রামাঞ্চলের লোকজনের কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙ্গতো। জমি চাষের জন্য লাঙ্গল জোয়াল আর গরু নিয়ে মাঠে যাওয়ার জন্য। কাঠমিস্ত্রির বাড়িতে ভিড় জমে থাকতো লাঙ্গল,জোয়াল,আর মই মেরামত করার জন্য। মেরামত না করতে পারলে ওইদিন আর হালচাষ করা সম্ভব হতো না। সেই কাঠমিস্ত্রিদের সংসার চলতো কৃষকের লাঙ্গল-জোয়াল আর মই মেরামত করে। কিন্তু আধুনিতার ছোঁয়ায় কাঠমিস্ত্রির বাড়িতে এখন আর কেউ লাঙ্গল-জোয়াল-মই নিয়ে যায় না। ফলে বাঁচার তাগিদে পেশাও পরিবর্তন করেছে তারা।
বর্তমান বাংলাদেশ আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিতে এগিয়ে। তাই গ্রামাঞ্চলের গৃহস্থের ঘুম ভাঙ্গে ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলারের শব্দে। তখনকার সময়ে জমিতে বীজ বপন অথবা চারা রোপণের জন্য জমি চাষের জন্য গরুর হাল ব্যবহার করতো কৃষকরা। পরে বড় বড় মাটির টুকরো গুড়িয়ে সমান করার জন্য মই ব্যবহার করা হতো। যা কৃষিকাজের জন্য ব্যবহৃত অন্যতম পুরনো যন্ত্র। তখন জমি চাষের জন্য প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়ীতে একাধিক গরু-মহিষ লালন-পালন করা হতো। লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ করতে কমপক্ষে একজন লোক ও দুইটি গরু বা ২টি মহিষ প্রয়োজন পড়তো। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পুরোনো হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লাঙ্গল, জোয়াল, মই, গরু-মহিষ আর হালচাষের সময় কৃষকের মুখে ভাটিয়ালী-পল্লীগীতি গানের সুর। উপজেলার অচিন্তপুর ইউনিয়নের ফুলবাড়িয়া গ্রামের কৃষক শহীদ মিয়া জানান, ১০ -১২ বছর আগে ময়মনসিংহ বা পার্শ্ববর্তী জেলা নেত্রকোনায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছিল গরুর হালের যোগাড়-যন্ত্র আর গরু-মহিষ। তখন গরু-মহিষগুলোকে নিজেদের পরিবারের সদস্যের মতো লালন-পালন করা হতো। তাদের দিয়ে একরের পর একর জমি চাষ করার কাজে ব্যবহার করা হতো।
তাজা ঘাস আর ভাতের ফেন, সরিষার খৈল-ভুসি ইত্যাদি খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করে তোলা হালের জন্য জোড়া গরু-মহিষকে দিয়ে জমি চাষ করতেন কৃষক। সেকালে গৌরীপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন একটি পৌরসভা সহ প্রায় প্রতিটি গ্রামে থাকা জমিগুলোতে কৃষক লাঙ্গল জোয়াল, মই গরু দিয়ে জমি চাষাবাদ করতেন। চাষের মৌসুমে তাদের কদরও বেড়ে যেতো।
উপজেলার মাওহা ইউনিয়নের ধেরুয়া কড়েহা গ্রামের কৃষক মঞ্জিল মিয়া জানান, প্রতি মৌসুমে অনেক কৃষকের দিন কেটেছে ফসলের মাঠে লাঙ্গল-গরু দিয়ে চাষ করে। তিনি বলেন গরু দিয়ে হালচাষ করলে জমিতে ঘাস কম হতো, পায়ে হেটে হাল-চাষ করায় গরুর পা ও কৃষকের পায়ের চাঁপে ঘাসগুলো কাঁদায় ডেবে যেতো। এতে করে জমিতে অনেক জৈব সার তৈরী হতো, এবং ফসলও ভালো হতো। তাছাড়া গরু-নাঙ্গলের হাল-চাষ কিন্তু মাটির অনেক গভীরে গিয়ে মাটির উর্বরতা শক্তি বহলাংশে বৃদ্ধি করতো। তাই জমিতে খুব একটা সার প্রযোগ করতে হতো না। জৈব্য সার দিয়েই কাজ চলে যেতো। বর্তমান সরকার আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কৃষি ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য নিয়ে এসেছে।
গৌরীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুন্নাহার বলেন, কম সময়ে জমি চাষ করতে গিয়ে পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর ব্যবহার হচ্ছে যা এতটা মাটির গভীরে যেতে পারে না। ট্রাক্টর বা পাওয়ারটিলার দিয়ে কম সময়ে জমি চাষ করা যায় তাই কৃষকরা গরু দিয়ে হালচাষ বাদ দিয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের কষ্ট কমার পাশপাশি ফলনও পাচ্ছে বেশী। তা ছাড়া কৃষকের সুবিধার জন্য এখন প্রত্যক এলাকায় কৃষক সমিতির মাধ্যমে সরকার কৃষকদের পাওয়ার টিলার,,ট্রাক্টর, ফসল কাটার যন্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরন বিতরন করছে। তাই গরু আর লাঙ্গল দিয়ে হাল-চাষ করার কোন প্রশ্নই উঠে না। এক্ষত্রে পুরোনো গ্রামীন ঐতিহ্য গরু-আর লাঙ্গলের হাল চাষ ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ।