ফাতেমা মুজিব। সদ্য সমাপ্ত এসএ গেমসে বাংলাদেশের ১৯ স্বর্ণ পদকের একটি এসেছে তার তলোয়ার থেকে। হবিগঞ্জ উসাই নগরের এ যুবতি দেশকে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বর্ণ এনে দিয়েছেন ফেন্সিং থেকে। যে খেলাটি সম্পর্কে দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা নেই। অখ্যাত সেই খেলা থেকেই ভারতীয় আধিপত্যের মধ্যে থেকে একটি স্বর্ণ ছিনিয়ে এনেছেন ফাতেমা মুজিব।
নারীদের ব্যক্তিগত সাবরে ইভেন্ট থেকে ফাতেমা স্বর্ণ জিতেছেন কোয়ার্টার ও সেমিতে ভারতীয় এবং ফাইনালে নেপালি প্রতিপক্ষকে হারিয়ে। এর আগে হিটে ৫ জনকে হারিয়ে শেষ ষোলোতে উঠেছিলেন ফাতেমা। তিনি সাবরে ইভেন্টের দলগত বিভাগে পেয়েছেন ব্রোঞ্জ।
অপ্রচলিত খেলা থেকে দেশকে সম্মান এনে দেয়া ফাতেমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা মো. খোরশেদ আলী বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন গেমস চলাকালীন সময়ে। ঠিক ফাতেমার স্বর্ণজয়ের পরের দিন। ফাতেমা নেপালে স্বর্ণ জিতেছেন ৭ ডিসেম্বর। পরের দিন তার বাবাকে ভর্তি করা হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।
‘বাবা যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং হাসাপতালেও ভর্তি করা হয়েছে তা আমাকে বাসা থেকে জানানো হয়নি। বাবাকে ৮ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় হৃদরোগে আক্রান্ত হলে। পরের দিনও আমার খেলা ছিল। তাই আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। বাবা এখনো হাসপাতালে। ডাক্তাররা বলছেন তার হার্টে রিং পরানো লাগতে পারে’- জাগো নিউজকে বলছিলেন স্বর্ণজয়ী ফেন্সার ফাতেমা মুজিব।
বাবার অসুস্থতার কথা কখন জানলেন? ‘বাসা থেকে আমার ভাই বাবা অসুস্থ হওয়ার পরই খবরটি জানিয়ে রেখেছিলেন স্যারকে (নেপালে অবস্থানরত ফেন্সিংয়ের সাধারণ সম্পাদক মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম)। কিন্তু আমাকে জানাতে নিষেধ করেছিলেন। আমি ঢাকায় ফেরার পর বিমান বন্দরে স্যার আমাকে প্রথম জানান এ খবর। আমি কলোনীতে ফিরে খেলার সরঞ্জামাদী জমা দিয়ে পরের দিন সকালে বাবাকে দেখতে হাসপাতালে যাই’- বলেন ফাতেমা মুজিব।
ফাতেমার এ স্বর্ণজয় সহজ ছিল না। কারণ, ভারতের প্রতিপক্ষদের সঙ্গে পেরে ওঠা ছিল কঠিন। হিটে দুই ভারতীয় এবং একজন করে পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলংকান প্রতিপক্ষকে হারিয়ে শেষ ষোলোতে উঠেছিলেন ফাতেমা। সেখানে হারান এক পাকিস্তানী মেয়েকে। তারপর কোয়ার্টার ও সেমিতে ভারতের প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ওঠেন ফাইনালে। ফাইনালে হারান স্বাগতিক নেপালের প্রতিপক্ষকে। স্বর্ণ জিততে ফাতেমাকে এক দিনেই হারাতে হয়েছে ৯ জন প্রতিযোগিকে।
ফেন্সিংয়ে ভারতের একচেটিয়া প্রাধান্য। গেমসে ১২ ইভেন্টের মধ্যে ভারতীয়রাই জিতেছেন ১১ স্বর্ণ। একটি ছিনিয়ে এনেছেন লাল-সবুজ দেশের ২২ বছরের যুবতী ফাতেমা মুজিব।
ফেন্সিংয়ে ফাতেমার হাতেখড়ি ২০১৩ সাল থেকে তার ভাই সাদ্দামের হাত ধরে। তার সেজো ভাই সাদ্দাম জাতীয় পর্যায়ে ফেন্সিং খেলেন। নিজের অনুশীলনের জন্য সাদ্দাম ছোট বোন ফাতেমার হাতে তলোয়ার দিয়ে প্রতিপক্ষ বানাতেন। এভাবেই ফেন্সিংয়ে আশক্ত হওয়া ফাতেমা এখন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফেন্সার। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে চারটি গোল্ড জেতা ফাতেমা প্রথম আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণেই জিতে নিয়েছেন স্বর্ণ।
ভাইয়ের অবদান ভোলেননি ফাতেমা। তাইতো এসএ গেমসে জয় করা স্বর্ণটি উৎসর্গ করেছেন তাকে। ঢাকায় ফিরেই নেপালে যেতা সোনার পদকটি তুলে দেন ভাই সাদ্দাম মুজিবের হাতে।
ফাতেমা বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে যোগ দেন ২০১৬ সালে। উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এ বছর এসএসসি পাস করেছেন মিরপুর আলহাজ মধু বেপারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। নৌবাহিনী থেকে পাওয়া সম্মানী, বড় ভাই হাসানের আয় আর বাবার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া ভাতাতেই মূলতঃ চলে ফাতেমাদের সংসার। যে কারণে, লেখাপড়া নিয়মিত রাখতে পারেননি এ স্বর্ণকন্যা।
প্রথম আন্তর্জাতিক মিটে অংশগ্রহণ। ভেবেছিলেন স্বর্ণ জিততে পারবেন? ‘আসলে আমাদের একজন কম্বোডিয়ার কোচ এবং স্থানীয় আবু জাহিদ চৌধুরী স্যারের কাছে আমি যে অনুশীলন করেছি তাতে প্রত্যাশা ছিল ভালো কিছু করতে পারবো’- বলেছেন ফাতেমা মুজিব।
ফেন্সিং খেলা মানেই তো তলোয়ারবাজি। তো ভয় লাগে না? ‘প্রথম-প্রথম লাগতো। এখন ভালোই লাগে। কোনো ভয় করে না। আমি এই খেলায় আরো বড় হতে চাই’- বলেন এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী ফাতেমা।
স্বর্ণজয়ের পর কেমন লাগছে? বন্ধুরা এবং আত্মীয়স্বজনদের প্রতিক্রিয়া কেমন? ‘অনেক ভালো। অনেকে ফোন করছেন অভিনন্দন জানাচ্ছেন। গিফটও পাচ্ছি মিষ্টি, কলম, পুতুল (বলেই হাসি)।’ নিজের স্কুলে যাননি এসে? ‘যেতে পারিনি। যাবো। সবাইকে আমার পদক দেখাবো। পদক না নিয়ে গেলেও মোবাইলে ছবি তুলে নিয়ে যাবো’- বলছিলেন ফাতেমা মুজিব।
এত আনন্দের মধ্যেও গভীর এক দুঃখ আছে ফাতেমার। কারণ, ফাতেমার বয়স যখন দুই-আড়াই বছর, তখন মারা যান তার মা হাছিনা বেগম। ছোট বয়সে মারা যাওয়ার কারণে মায়ের মুখটাও মনে নেই তার। তবে ৭ ডিসেম্বর স্বর্ণজয়ের পর বেশি বেশি মায়ের কথা মনে পড়েছিল ফাতেমার। ৭ ডিসেম্বর যে ছিল তার জন্মদিন!
মিরপুরেই ফাতেমার মায়ের কবর। পদক জিতে ঢাকায় ফেরার পর গতকাল (বুধবার) বাবাকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার আগে মায়ের কবর দেখে গিয়েছিলেন ফাতেমা। সঙ্গে ছিলেন তার বড় ভাই হাসান মুজিব।
ফেন্সিং খেলাটা কি? জানেন না অনেকে। বাংলাদেশ ফেন্সিং অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেলেন, ‘২০০৭ সালে আমি এই অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করি। ২০০৮ সালে ১০জন ছেলে নিয়ে শুরু হয় আমাদের ট্রেনিং কার্যক্রম। এরপর ২০১১-১২ থেকে খেলার প্রসার বাড়তে থাকে আনসার, বিজিবি, নেভি ও আর্মি এ খেলার কার্যক্রম শুরু করায়। এখন সারাদেশে ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ ফেন্সার আছে। খেলাটা ব্যয়বহুল। যার ওপরে খেলা হয় তাকে বলে পিস্ট। যার মূল্য ৮-১০ লাখ থেকে ২৪-২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। আর খেলোয়াড়দের জ্যাকেটসহ সবকিছু দিয়ে একজনকে সাজাতেই লেগে যায় হাজার পঞ্চাশে টাকা। পিস্ট এবং জ্যাকেট দুটোতেই থাকে কম ভোল্টের ইলেকট্রিক ডিভাইস। তলোয়ারকে বলা ব্লেড। কোনো ধার থাকে না। মাথায় একটা বাটন থাকে। তা প্রতিপক্ষের শরীর স্পর্শ করলে বাতি জ্বলে এবং পয়েন্ট হয়।’